‘বিপ্লবী’ বাইডেনের হাত থেকে আমেরিকাকে উদ্ধার করবে কে? মার্কিন মুলুক থেকে লিখছেন দীপিকা ঘোষ


কেমন চলছে বর্তমান প্রশাসনে সুপার ডুপার আমেরিকা? আপাতত এ প্রশ্ন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই। মার্কিন মিডিয়াতেও এখন রোজকার খবর – Biden’s approval hits new low as inflations, crime rates surge. অবশ্য বাইডেনের জনপ্রিয়তা হ্রাস কেবল লাগামহীন ক্রাইম আর মুদ্রাস্ফীতির কারণেই নয়। আমেরিকার বর্তমান নেতৃত্ব সম্বন্ধে নাগরিক অসন্তোষ বৃদ্ধির পেছনে অন্য ইস্যুও রয়েছে। এই যেমন কিছুদিন আগে তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলো প্রেস কনফারেন্স শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হ্যাণ্ডশেক করার বিষয়টি নিয়ে। সমালোচকরা বললেন, কেউ সামনে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট শূন্যে হাত তুলে হ্যাণ্ডশেক করেছেন। সে করমর্দন কার সঙ্গে হয়েছে? অবশ্যই হাওয়ার (বাতাসের) সঙ্গে! যিনি সামনে কেউ উপস্থিত রয়েছেন কিনা সেটাই মালুম করতে পারেন না, আমেরিকার কমাণ্ডার ইন চিফ হিসেবে তাঁকে অভিনন্দিত করার কোনো কারণ থাকে কি? বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে এই কারণেই আমেরিকা এখন সব কৌতুককর সংবাদের শিরোমণি! সমালোচকরা আরও বলছেন – জোসেফ বাইডেনের ৫০ বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা আগেও প্রমাণ করেছে যে তিনি সবক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ!
তাহলে তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্টের পদে বসিয়ে দেওয়া হলো? তাঁর প্রেসিডেন্সিতে সব ডেমোক্র্যাট নেতারাই কি সমর্থন দিয়েছিলেন? একেবারেই নয়। বলা হচ্ছে নতুন ডেমোক্র্যাটিক দলের বেগমান ঘোড়ার লাগাম যাঁর হাতে, অর্থাৎ অদৃশ্যভাবে পেছনে দাঁড়িয়ে যিনি রাজনীতি আর জনতার আবেগকে একাকার করায় সফল হয়েছেন, তাঁরই ইচ্ছায় এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। এটা এখন ওপেন সিক্রেট, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ওবামার তৃতীয় টার্ম চলছে। জোসেফ বাইডেন কেবল চোখের সামনে সাজিয়ে রাখা প্রেসিডেন্ট। ‘Biden is just Obama’s front man.’ এ মন্তব্য এখনও সংবাদপত্রের শিরোনাম। সে জন্যই ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার নতুন করে যুদ্ধযাত্রা। অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি সত্ত্বেও ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্যের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দান। সেই সঙ্গে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করা। চিনের কাছে নতজানু থাকার পুরনো পলিসি অনুসরণ। বর্তমান সরকারকে চিনেরও পুরনো সুহৃদ বলে সম্বোধন। ইরানের নিউক্লিয়ার ডিল সাকসেসফুল হলে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে জেনেও নতুন করে ডিল বাস্তবায়নের প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনসমাজ থেকে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের গভীরভাবে বিভক্তিকরণ। তবে এটাও সত্যি যে ওবামার প্রশাসনে যে অবক্ষয়ের শুরু, বাইডেন প্রশাসনে দুর্বল নেতৃত্বের কারণে তা চরমভাবে প্রকট।
অপরিকল্পিতভাবে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস-এর নামে ক্রিমিন্যালদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান, তেলগ্যাসসহ নিত্যপণ্যের একটানা মূল্য বৃদ্ধি, বেবি ফর্মূলা দেশের মার্কেটে শিশুদের জন্য না থাকলেও সীমান্তে মাইগ্র্যান্ট শিশুদের জন্য মজুদ করা, ওপেন বর্ডার পলিসি চিরস্থায়ী রাখার উদ্দেশ্যে ইমিগ্রেশন রুল Title-42 বাতিল, দেড় বছর ধরে বিরামহীনভাবে অবৈধ মাইগ্র্যান্টদের অনুপ্রবেশ, এগুলোর কোনোটাকেই সমর্থন করছেন না মার্কিন জনগণ। কারণ শুধুমাত্র ২০২২-এর এপ্রিলেই টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে ২৩৪০৮৮জন মাইগ্র্যান্ট। যাদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ক্রিমিন্যালরাও রয়েছে। ফলে নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা। মেক্সিকো থেকে টেক্সাস পর্যন্ত আণ্ডারগ্রাউণ্ড টানেল দিয়ে স্মাগলারদের ড্রাগ পাচার চলছে বিরামহীন। ড্রাগ আসক্ত তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত। বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকানদের উদ্বিগ্নতাও বাড়ছে তাই। এ ছাড়া প্যানডেমিক ফাণ্ডের মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থের অপচয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা, বর্ণবাদ ধ্বংসের নামে সর্বস্তরে রেসিজমকে জাগিয়ে তোলা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাক স্বাধীনতা হরণ, দলীয় ক্যাডার সৃষ্টি, ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস-এর নামে রমরমা বানিজ্য এবং অতি সম্প্রতি এ্যাবরশন ইস্যু নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে চরমপন্থীদের এক মাস ধরে হুল্লোড়, বাইডেনের প্রেসিডেন্সি নিয়ে বিরক্তি জাগাচ্ছে জনমনে।
সুতরাং ২০২২-এর ৩ থেকে ৭ই মে পর্যন্ত যখন জনমত যাচাইয়ের জন্য জানতে চাওয়া হয়েছিল কেমন চলছে আমেরিকা? তখন ৮০ শতাংশেরই জবাব ছিল, ভুল পথে। মাত্র ১৮ শতাংশ জানিয়েছিলেন ঠিকই চলছে। ঠিক যে চলছে না দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, বিদেশনীতি, সমাজনীতিসহ জীবনসম্পৃক্ত সব বিষয়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই সবার বোধোদয় হয়। প্রেসিডেন্ট অবশ্য বলেছেন, যেমনটা ২০২১ সালে মাঝে মাঝেই বলতেন – America’s best days are ahead! It just does not feel that way right now! আমেরিকার মধুময় দিন সামনেই রয়েছে। কেবল পরিস্থিতির কারণে কেউ সেটা বুঝতে পারছেন না। তাই কুয়াশাময় পরিস্থিতি সরিয়ে শুভ দিনের চেহারা যাতে সাধারণের নজরে পড়ে, তার জন্য বাইডেন প্রশাসন অতি শীঘ্র ‘The Ministry of Truth’ নামে সত্য প্রচারের একটি মন্ত্রনালয় খুলতে যাচ্ছে। সব সত্য আর শুভ সংবাদ পরিবেশনের দায়িত্ব এখন থেকে এই মন্ত্রনালয়ই পালন করবে। CNN-সহ যে সমস্ত জাতীয় মিডিয়া ২০১৬ থেকে ২০২২ অবধি নতুন ডেমোক্র্যাটিক দলের বাণ্ডিল বাণ্ডিল অপরাধের তালিকা জনতার চোখের আড়ালে সাবধানে সরিয়ে রেখেছিল, তাদের প্রতিও এখন আর নতুন ডেমোক্র্যাটদের আস্থা নেই।
বলা বাহুল্য ক্রমাগত অভূতপূর্ব আইডিয়ার প্রচলন এবং অসাধারণ ঘটনাবলীর জন্মদান বাইডেন প্রশাসনের বিশেষত্ব। এই যেমন, অবৈধ মাইগ্র্যান্টদের জন্য সীমান্ত চিরস্থায়ীভাবে উন্মুক্ত রাখা। আমেরিকার মাটিতে পা দিলেই তাদের ভোটদানের সুযোগ দান। আইডি কার্ডের প্রয়োজন অন্যক্ষেত্রে জরুরি হলেও ভোটপ্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। খুণী দাগী আসামীরা জেলমুক্ত থাকলেই তাদের অপরাধ প্রবণতা বিদায় নেয়। রাষ্ট্রে জেলখানার সংখ্যা যত কম হবে, দিনে দিনে রাষ্ট্র ততোই অপরাধশূন্য হবে। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চাইলে পুলিশ প্রশাসনের অবলুপ্তি দরকার। এখন থেকে কমিউনিটি রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের নয়, কমিউনিটির। প্রতিবেশির ধনপ্রাণ রক্ষা করবেন প্রতিবেশি। তাতে সৌজন্যবোধ বাড়বে। সৌভ্রাতৃত্বের রাখিবন্ধন পরে মানুষ সমাজজুড়ে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করবে। অবশ্য নেতারা মাসে ১০ হাজার ডলার ব্যয় করেও বডিগার্ড রাখতে পারবেন। কারণ তাদের দেহ সাধারণ মানুষের চাইতে মূল্যবান। স্কুল কলেজের ছাত্রমেধায় সমতা আনার জন্য কোর্সওয়ার্কের মান কমাতে হবে। তাহলেই কেবল ছাত্রসমাজে ‘Fair equality of opportunity’ থিওরি ফলপ্রসু হবে। সেক্সসংক্রান্ত পাঠদান শিশুদের দিতে হবে আড়াই বছর বয়স থেকে। যাতে কচি বয়সেই এ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন পূর্ণ হয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় অবৈধ মাইগ্র্যান্টদের হোটেলে থাকার সুযোগ চাই। এছাড়া ক্যান্সেল কালচার ফরমূলা অনুসরণ করে সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতির খোলনলচে বদলে ফেলা, সন্তান পিতামাতার নয় রাষ্ট্রের সম্পত্তি ইত্যাদি থিওরিসহ হাজারো আবিষ্কার, বাইডেন প্রশাসনের এক একটি অগ্নিগর্ভ বিপ্লবী মিসাইল।
এ যাবত আমেরিকা তার বিভিন্ন ক্যাটাগরির ডিপ্লোম্যাসিতে জগতের অনেককেই নাকি উদ্ধার করে আত্মতৃপ্তি পেয়েছে। এবার অজস্র অভূতপূর্ব ঘটনা সৃষ্টিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেন প্রশাসনের বিপ্লবী তেজে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সহস্র শিখায় জ্বলছে, তার থেকে এখন তাকে উদ্ধার করবে কে?

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!