কলকাতার রাজপথে বঞ্চিত আদিবাসীদের মিছিলই বাঁচার পথ দেখাতে পারে, ক্ষোভ বাবু – বিবি আর মিডিয়ার!

প্রসূন আচার্য

কলকাতার মানুষ আজ বেজায় চটেছে। এক দল আদিবাসী পুরুষ এবং মহিলা দীর্ঘ মিছিল করে হাওড়া এবং শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ধর্মতলায় যায়। ধর্মতলায় রাণী রাসমণি রোড তাদের সভা ছিল। এই মিছিলের ফলে অফিস টাইমে মধ্যকলকাতায় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। বহু মানুষের প্রশ্ন : এরা কারা ? কেন এই ভাবে অফিস টাইমে কলকাতায় মিছিল করছে? এবং পুলিশ কিছু বলছে না ? প্রশ্ন তোলে কলকাতার বিভিন্ন মিডিয়া। তাদের মতে পুজোর আগে এই ভাবে মিছিল করা অত্যন্ত অন্যায়।

সবিনয়ে জানতে চাই, এই মিছিলের নেতৃত্বে ছিল ভারত জাকাত মাঝি পারগনা সংগঠন। জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গের বহু আদিবাসী এই মিছিলে যোগ দেন। এমনকি অনেকে কোলের বাচ্চা নিয়েও এসেছিলেন। এই মিছিল এবং কর্মসূচি ছিল পূর্ব ঘোষিত। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের রাণী রাসমণি রোডের সভার আগাম অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। মিছিলের মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে: সিধু কানহু বিরসা মুন্ডা জিন্দাবাদ।

কিন্তু কেন তির ধনুক, বল্লম বা সিঙ্গা নিয়ে এই প্রতিবাদ মিছিল? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, যে ভাবে উন্নয়নের নামে রাষ্ট্র আদিবাসীদের জমি একের পর এক গায়ের জোরে কেড়ে নিচ্ছে, জঙ্গল ও পাহাড় ধ্বংস করার জন্য তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে, তার বিরুদ্ধেই এই মিছিল।

সেই সঙ্গে সাঁওতাল আদিবাসীদের জন্য অলচিকি লিপিতে (ভাষায়) পরীক্ষা ইত্যাদি দাবিও রয়েছে। মোদ্দা কথা যারা গ্রেটা থুরেনবর্গের নাম বাপের জন্মে শোনেনি, কিন্তু প্রকৃতি আর পরিবেশকে হাজার হাজার বছর ধরে দেবতা হিসেবে মেনেছে, যাদের জন্ম থেকে মৃত্যু কাটে প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে, তাই সেই প্রকৃতি দেবতাকে রক্ষার দাবিতে এই মিছিল। এই মিছিল বাবু পরিবেশবিদদের, যাঁরা পরিবেশের নাম করে বিদেশ ঘোরেন, সেমিনারে বক্তিমা দেন, তাঁদের গালে একটা বিরাট চড়।

অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গল কেটে বাঁধ দিয়ে ঠুগরা পাম্প স্টোরেজ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করা হবে। রাজ্য সরকার জাপানি সহযোগিতায় এই প্রকল্প করতে বাধ্যপরিকর। কিন্তু এতে শুধু কয়েক লক্ষ গাছ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হবে না, ওখানকার বাস্তু তন্ত্র ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে হাজার হাজার প্রাণী ও পাখি। যারা অযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করে বাঁচে। ধ্বংস হবে পাহাড়ি নদী, বর্ষায় যার জলে চাষ করেন এই আদিবাসীরা। এর বিরুদ্ধে আদিবাসী ও একদল পরিবেশকর্মী দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই আর প্রচার আন্দোলন করছে। সরকারের কাছে , বিশেষ করে মহকুমা ও জেলায় ডেপুটেশনও দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার পিছু হঠেনি। বাধ্য হয়ে তাঁরা প্রতিবাদের জন্য বেছে নিয়েছেন কলকাতার রাজপথ।

*বাম আমলে এক বার বহু ঘটা করে পাম্প স্টোরেজ বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করে ওই এলাকার বড় অংশের প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে।* *যার ক্ষতি কোনও দিনই পূরণ হওয়ার নয়*। আবার তৃণমূল সরকারও সেই পথেই হাঁটছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস হাই সুগার নিয়ে খেলা, মেলা বোঝেন, টলিউডের প্রত্যেক গ্ল্যামারাস নায়িকাকে চেনেন, তাঁদের নিজের পক্ষে কী করে টানতে হয় তাও ভালই জানেন, কিন্তু অরূপ পরিবেশ বোঝেন, বাস্তুতন্ত্র বোঝেন, এটা তাঁর অতি বড় শত্রুও বলবে না!

আরও আছে। পুরুলিয়ার তিলাবনী পাহাড় যে ভাবে কর্পোরেট এর কাছে রাজ্য সরকার বিক্রি কার্যত করে দিয়েছে, পাহাড়টি ধ্বংস করে তার পাথর বিক্রি করার জন্য, এই মিছিল ছিল তার বিরুদ্ধে। পাহাড়ের দখল নিতে গিয়ে আগে একাধিকবার আদিবাসীদের সংঘবদ্ধ বিক্ষোভের মুখে পড়েছে জেলা প্রশাসন। বুলডেজার নিয়ে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। এই বার খোদ কলকাতার বুকে ছিল বিক্ষোভ দেখানোর পালা।

রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জোর করে আদিবাসীদের জমি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে ভারত জাকাত এর অভিযোগ। সরকারি আইন রয়েছে, যে আদিবাসীদের জমি নেওয়া যায় না। কিন্তু ভয় দেখিয়ে, প্রশাসনের কর্তাদের টাকা খাইয়ে সেই কাজ করা যায়। সবাই জানেন। উত্তরবঙ্গ থেকে জঙ্গলমহল সর্বত্র একই অভিযোগ। এদিনের মিছিলের স্লোগান ছিল: জোর করে ভয় দেখিয়ে আদিবাসীদের জমি নিতে দিচ্ছি না। দেব না।

এই জমায়েত আর মিছিলের আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল ডিউচাতে যে কয়লা খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সেখানেও আদিবাসীদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে তবেই কয়লা তোলা সম্ভব। সামনে সরকারি যে নামেই থাকুক, বকলমে এই কয়লা তুলবে আদানি। তাদের পাওয়ার প্লান্টের জন্য কয়লার দরকার। ঝাড়খণ্ডের যে সেজ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ চড়া দামে বিক্রি করা হবে বাংলাদেশে, সেখানকার জন্য দরকার। যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে হাই টেনশন লাইন যাওয়ার জন্য কিছুদিন আগে ফারাক্কায় আম ও লিচু বাগান কাটা হয়েছে প্রশাসনের মদতে। এবং কংগ্রেসের সাংসদ অধীর চৌধুরীর ভূমিকাও যেক্ষেত্রে মোটেই ভালো নয়। এমনকি তিনি বিক্ষোভ দেখানো কংগ্রেসের কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি পর্যন্ত। সেই দেউচা পচামীর জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে এই মিছিল।

এতটা পড়ার পরে নিশ্চয় কলকাতার বাবুদের একাংশ বুঝতে পারছেন, এই মিছিল, এই বিক্ষোভ, ঠিক কতটা প্রয়োজন আজকের দিনে।

বড় মিডিয়ার ভূমিকা সব সময়েই কর্পোরেট পুঁজি আর সরকারের পক্ষে। তাই আমরা তৃণমূলের ২১ জুলাই, বিজেপির নবান্ন অভিযান বা সিপিএমের ইনসাফ সভাকে পক্ষে বিপক্ষে সমর্থন করি, কিন্তু আদিবাসীদের মিছিল দেখলে, বা তারজন্য ট্রাফিক জ্যামে পড়লে বিরক্ত হই।

বাম আমলে বিচারপতি অমিতাভ লালা ঠিক এই রকম আদিবাসীদের একটি মিছিলে হাইকোর্ট যাওয়ার পথে আটকে পড়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কলকাতায় ছুটির দিন ছাড়া কোনও মিটিং মিছিল করা যাবে না। যা চ্যালেঞ্জ করে সিপিএমের বিমান বসু কিছু কথা বলেছিলেন। আমি লিখেছিলাম আনন্দবাজারে। হেডিং হয়েছিল: লালা কলকাতা ছেড়ে পালা। আমার আর বিমানবাবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

আবার বলি, এই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর বিপদের দিনে আদিবাসীদের এই ধরনের মিছিল আর বিক্ষোভ একমাত্র বাঁচার পথ দেখাতে পারে। কারণ তারাই পারে প্রকৃতি ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সরকারকে বাধা দিতে।

*পুনঃ* এই মিছিলের সঙ্গে মাহাত কুর্মীদের আদিবাসী মর্যাদা পাওয়ার জন্য চার দিন ট্রেন লাইন অবরোধের কোনও সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সাবধান!

সৌজন্য : লেখক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!