কতটা বদল হতে পারে রাজনীতির চালচিত্র ভারত জড়ো যাত্রায়?


– কল্যাণ সেনগুপ্ত



ইতিমধ্যেই সবাই জানেন যে, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ৭ই সেপ্ট. কন্যাকুমারিকা থেকে শুরু হয়েছে, যাবে কাশ্মীর পর্যন্ত। প্রায় ৩৫৭০কিমি. লম্বা এই যাত্রা চলবে প্রায় পাঁচ মাস ধরে। এই যাত্রা কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে শুরু হলেও এর সমর্থনে এগিয়ে এসেছে দেশের প্রায় দেড়শো সক্রিয় সামাজিক সংগঠন। গত ২২শে আগস্ট দিল্লীর কনস্টিটিউশন ক্লাবে এবিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার উদ্যোক্তা ছিলেন মেধা পাটকর, অরুণা রায় সহ প্রমুখ সুপরিচিত সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় নিয়ে গোড়া থেকেই এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত আছেন যোগেন্দ্র যাদব। তাঁর মূল্যবান পরামর্শ রাহুল গান্ধীকে সঠিক দিশায় চালিত করতে সাহায্য করছে। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আগামী দিনের জন্য এটি অত্যন্ত ইতিবাচক এক ঘটনা। এই যাত্রা নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের মরা গাঙে বান ডাকাবে। এই যাত্রার মধ্য দিয়ে রাহুল গান্ধী ফিরে পাবেন আত্মবিশ্বাস, কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকরা দীর্ঘকালীন হতাশা কাটিয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। গোষ্ঠীদ্বন্ধে জর্জরিত ও হতাশ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যাত্রারূপী লড়াইয়ের আগুনে পুড়ে ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করবে। স্বাধীনতাপূর্ব কালে যে সংগ্রামী চেহারা ছিল কংগ্রেসের, তা হয়তো খানিকটা হলেও আবার ফিরে আসবে। মানুষের ভরসাও হয়তো ফিরবে।

এর সাথেই অনিবার্যভাবে একটি প্রশ্ন আসবে যে, কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি কি সত্যিই দেশের কোন উপকারে আসবে? এর উত্তরে বলতে হয়- সম্পুর্ন না হলেও কিছুটাতো বটেই। কারণ, এই মুহূর্তে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে মোদি তথা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এবং সেটি করতে গেলে সমস্ত বিরোধী পক্ষকে একটা জায়গায় আসতেই হবে। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে নিয়ে সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলা এই মূহুর্তে বেশ কঠিন। যাত্রা সফল হলে আশা করা যায়, পরিস্থিতি অনেকটাই অনুকূল হবে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে দুশোর ওপর আসনে বিজেপি তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে সরাসরি লড়াইয়ে সম্পুর্ন পরাভূত করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। যাত্রার মাধ্যমে কংগ্রেস শক্তিশালী হলে ও বিজেপিকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে ফেলতে পারলে জাতীয় রাজনীতির চালচিত্রই বদলে যাবে।

সবাইকে বুঝতে হবে, বিরোধী ঐক্যকে সংহত করতে হলে এবং বিকল্প সরকারকে সদর্থক দিশায় পরিচালিত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি শক্ত খুঁটির। এই যাত্রা সফল ভাবে শেষ হলে কংগ্রেস দল সেই কাঙ্খিত খুঁটিরূপে আবির্ভুত হবে। অতঃপর সেই খুঁটিকে ঘিরেই গড়ে উঠবে এক শক্তপোক্ত বিরোধী শিবির। সেই কারণেই নিছক কংগ্রেসের স্বার্থে নয়, জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে এবং সময়ের ডাকে সমস্ত সামাজিক সংগঠনগুলি এই যাত্রাকে সহযোগিতা ও সমর্থন করতে সম্মত হয়েছে। এরই পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্তে শুরু হতে চলেছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ছোট ছোট যাত্রা আঞ্চলিক স্তরে। এভাবেই দেশজুড়ে বিভিন্ন দেশোদ্ধার যাত্রার মাধ্যমে সংবিধান ও গনতন্ত্র রক্ষার লড়াই সফল হবে। দেশব্যাপী জনজাগরণের ফলে ‘২৪এর নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে এবং মোদি-শাহ’র ক্ষমতা তথা বিজেপি শাসনকে সফলভাবে যোগ্য জবাব দেওয়া যাবে।

বিজেপি বিরোধী বহু মানুষ বা গোষ্ঠী কিন্তু মনে করে যে, আজকের দুরাবস্থা বা বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়া তথা প্রচন্ড শক্তিশালী হওয়ার জন্য মূল দায়ী কংগ্রেস। এই কংগ্রেসের দ্বারা দেশের আর কোন উপকার সম্ভব নয়। অতএব কংগ্রেসকে খরচা খাতায় রাখাই শ্রেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই যুক্তি বা কৌশল কিন্তু ভুল ও সর্বনাশা বলেই প্রমাণিত হবে। এমতাবস্থায় সমস্ত বিরোধী শক্তি যদি বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে একযোগে লড়াই না করে, তাহলে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই পরাজিত হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্থ হবে চূড়ান্তরূপে। এক ঢিলে দুই পাখি (বিজেপি ও কংগ্রেস) মারার খোয়াব দেখা বন্ধ না হলে সমূহ বিপদ ঘনাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য – ২০১৯এ কংগ্রেসের সার্বিক ব্যর্থতার পরে আরও অনেকের মতোই চূড়ান্ত হতাশা থেকেই যোগেন্দ্র যাদব বলেছিলেন, কংগ্রেসের মৃত্যুই এখন দেশের পক্ষে ভাল। কিন্তু সেই তিনিই এখন সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পরিস্থিতির চাহিদায় রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত জোড়ো যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। কারণ, তিনি বুঝেছেন বর্তমানে যে সংগঠনিক অবস্থা নিয়ে কংগ্রেস চলছে, সেই শক্তি বা ক্ষমতা নিয়ে লড়লে ২০১৯এর চেয়ে ভালো ফল হবার সম্ভাবনা কিছু নেই। ফলে এই সাংগঠনিক দৈন্য দশা কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি এবং সেটা করতে হলে রাস্তায় নামতে হবে ও জনসংযোগের মাধ্যমে মানুষের দুঃখ দুর্দশা ও তাঁদের বক্তব্যকে জানতে হবে। এসবের জন্য সবচেয়ে ভাল ও কার্যকরী পন্থা হচ্ছে- দেশব্যাপী যাত্রা সংগঠিত করা। অনেক দ্বিধা দ্বন্ধ কাটিয়ে সেই যাত্ৰা শুরু হয়েছে।

এই যাত্রায় যথাসম্ভব বিলাসবাহুল্যকে বর্জন করা হয়েছে। যাত্রায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে কোনরূপ বিশৃংখলা সৃষ্টির সম্ভাবনাকে প্রতিহত করতে। যাত্রাপথে ক্রমশঃ মানুষের ভিড়ের মাধ্যমে আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা আগামীদিনে মোদি-শাহের কপালে ভাঁজ ফেলতে বাধ্য। আশা করা যায় জানুয়ারি নাগাদ যখন এই যাত্রা দিল্লি পৌঁছবে, তখন তা কি রূপ নেবে, আগাম বলা মুশকিল। তবে তা যদি সত্যিই জনতার মহাপ্লাবনে পরিণত হয়, তখন ঘাবড়ে গিয়ে মোদি কি পদক্ষেপ নেন, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছেনা। কিন্তু এমন আশঙ্কাও কেউ কেউ করছেন যে, খুব বেগতিক দেখলে মোদি কোন কড়া সাংবিধানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন বা সময়ে পরিস্থিতি অনুকূল না হলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য নির্বাচন স্থগিত করেও দিতে পারেন। ফলে সেই সংকট মোকাবিলায় প্রশাসন বনাম জনতার লড়াই নির্ধারন করবে কিন্তু জনসাধারণই। কারণ, আমাদের দেশটা চীন নয়, এখানে গণতন্ত্রের ভীত এতটাই মজবুত যে একবার জনতা রাস্তায় নেমে এলে গুলি-বন্দুক দিয়ে তাকে আদৌ ঠেকানো যাবেনা। শুরু হয়ে যাবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই এবং সে লড়াই জিতে ও অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন সরকার এগোবে এক জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে নতুন এক প্রগতির পথে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!