ভারতের অর্থনীতির কি শ্রীলঙ্কার দশা হতে চলেছে?

সুদেষ্ণা ভট্টাচার্য্য

ভারতের দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি একেবারে ধ্বসে গেছে। চালের দাম ৫০০টাকা কেজি,আলুর দাম ৪০০টাকা কেজি,বেবি ফুডের কেজি ২০০০ টাকা। বিদ্যুৎ নেই।কাজ নেই। লোকের আয় নেই।কাগজ কেনার পয়সা নেই তাই সরকারি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা বাতিল। জ্বালানি তেল আমদানির টাকা নেই, কারণ ফরেন রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশি ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি শোধ করতে হবে এখনি। কিন্তু সে টাকা নেই। অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার জন্য কেউ আর ঋণ দিচ্ছে না। দেবে কেন?ঋণ শোধের কোন উপায়ই নেই যে।
বিষদ আলোচনায় যাব না,কারণ সেটা উদ্দেশ্য নয়। শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় এশিয়া, আফ্রিকা,লাতিন ও মধ্য আমেরিকা এবং ইউরোপের দরিদ্র,পশ্চাদপদ ও প্রকৃত অর্থে পরাধীন দেশগুলোর জনগণের সামনে যে সত্য তুলে ধরছে সেটাই আমাদের জানা দরকার এবং তা হল : মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক ও চীনের ঋণের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি পরিচালনার পরামর্শের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের আমদানি নির্ভর অর্থনীতি চালিয়ে যাওয়ার অনিবার্য পরিণতি হল এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়।এককথায় সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির শোষণের ফাঁদে পড়ে ঘটেছে শ্রীলঙ্কার এই চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
ভারত কি সেই পথে? কেন আজ দেশব্যাপী চলছে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির সন্ত্রাস?ভারতের বর্তমানে ঋণের অবস্থা কী?এতো বড়ো একটি দেশ—যেখানে খনিজ ও বনজ কাঁচামালের অভাব নেই,অভাব নেই পুঁজি ও মেধা সম্পদের—সেই দেশ কেন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় ৭৫ বছর পরেও রয়ে গেল আমদানি নির্ভর? ঋণগ্রস্ততা,আমদানি নির্ভর অর্থনীতি ও মূল্যবৃদ্ধি —এ গুলোর আন্তঃসম্পর্ক কী? আলোচনা করব এইগুলো নিয়ে।
ভারত বিদেশি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে।এটা আর নতুন কথা নয়।এই মুহূর্তে ভারত সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৬ লক্ষ কোটি টাকা।এই ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ডলারে।১৪০ কোটি মানুষকে এই ঋণ মাথাপিছু ভাগ করে দিলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ হাজার টাকা।এর সাথে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসারত বিভিন্ন বিদেশি ব্যাঙ্ক, সরকারি ও দেশি বেসরকারি ব্যাঙ্কে ভারত সরকারের আরও বিপুল ঋণ আছে।দেশি বিদেশি সব মিলিয়ে বর্তমানে ভারত সরকারের ঋণের পরিমাণ ১৯৭ লক্ষ কোটি টাকা। মাথাপিছু ভাগ করে দিলে দাঁড়াবে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। ১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৫৫ শতাংশ। আজ আবার সেই একই রকম অবস্থার কাছাকাছি দেশ। বর্তমানে বিদেশি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২১.৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৫০-৫১ শতাংশ।
এছাড়া ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির মোট ঋণের পরিমাণ ৮০ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। কয়েকটি রাজ্যের ঋণের পরিমাণ— উত্তর প্রদেশের ৬ লক্ষ ১১ হাজির কোটি টাকা,গুজরাটের ৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি, পাঞ্জাবের ঋণ ২লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা,এই রাজ্যের জিডিপির ৫০ শতাংশ ঋণ। রাজস্থানের ঋণ ৪ লক্ষ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।পশ্চিমবঙ্গের ঋণের পরিমাণ ৫ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। রাজ্যগুলির মোট ঋণ রাজ্যগুলির জিডিপির ৩৫ শতাংশ। একজন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মাথায় ঋণের পরিমাণ কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে প্রায় ১লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভারতের ১৮টি রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার থেকেও খারাপ।
এর ফলে ২০২২-২৩ অর্থ বর্ষের ৩১ মার্চের মধ্যে দেশি-বিদেশি ঋণ ও অন্যান্য দায় মিলিয়ে ভারত সরকারকে মোট শোধ করতে হবে ১৫২ লক্ষ ১৭ হাজার ৯১০.২৯ কোটি টাকা(সূত্র:রিসিপ্ট বাজেট,২০২২-২৩, ডেট পজিশন অফ ইন্ডিয়া,নেট থেকে প্রাপ্ত)। কীভাবে এই ঋণ শোধ করা হবে?৩টি সহজ উপায় সরকার বেছে নিয়েছে।(১) পাবলিক সেক্টর ইউনিট বা পি এস ইউ বিক্রি করা,(২) রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অধীনস্থ জমি বিক্রি করা এবং (৩) নির্বিচারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো। আর তাতেও পূরণ না হলে নতুন করে ঋণ নেওয়া।
পি এস ইউ বিক্রয়: আপনারা সকলেই জানেন,বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির সংকট পাঁচ মহাদেশের পশ্চাদপদ দেশগুলোর জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। পদানত দেশগুলোতে শোষণ-লুন্ঠন অব্যাহত রাখা, জনগণকে বোকা বানানো আর দালাল শাসকশ্রেণীকে জনরোষের হাত থেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিবিদরা হাজির করে “অর্থনীতির উদারিকরণ ও অবকাঠামো ভিত্তিক উন্নয়নের তত্ত্ব”। অবকাঠামো উন্নয়ন বলতে বোঝায়—সড়ক নির্মাণ,সেতু ও উড়াল পুল নির্মাণ,বাঁধ নির্মাণ,জল ও নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন,সাবওয়ে নির্মাণ,রেলপথ বিস্তার, অসংখ্য বিমান ও সমুদ্র বন্দর গড়া ইত্যাদি। বিশ্বায়নের নীতি মেনে বাধ্য ছাত্রের মতো ভারত সরকার ১৯৯১-৯২ অর্থবর্ষের জন্য এই খাতে বাজেট বরাদ্দ করে ১লক্ষ ১৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। বাড়তে বাড়তে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে এই বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়ায় ২১লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকায়।কোথা থেকে এলো এই বিপুল পরিমাণ অর্থ?সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি ধার(আসলে অনুৎপাদক ক্ষেত্রে লগ্নি পুঁজি বিনিয়োগ করার জন্যই “অবকাঠামো ভিত্তিক উন্নয়নের তত্ত্বের” সৃষ্টি করেছে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিবিদরা)নিয়ে আর বিশ্বায়নের বেসরকারিকরণ পলিসি অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হবে। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষেত্র বেঁচে দিয়ে সেই পয়সায় ও লগ্নিপুঁজি ধার করে অবকাঠামো নির্মাণ।যা দাঁড়ালো,তা হল রাষ্ট্রের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলা। সুতরাং বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে দিল সরকার ।রেললাইন, রেলগাড়ি, রেলওয়ে স্টেশন, বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থা,খনি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। একেবারে শুরুতে এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে ৭টি সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া হল। তারপরে কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা ৮টি ও রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা একাধিক সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া হল।২০২১-এ লোকসভায় অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন সমস্ত সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা করেন।২০২১-এর ডিসেম্বরে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ২৬টি সংস্থা বিক্রির কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পাবলিক সেক্টর ইউনিটগুলিকে রুগ্ন করে দিতে শুরু করে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। যাতে শ্রমিকদের থেকে কোন প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে।২০১৪ সালে ৬৯ টি সরকারি সংস্থাকে,২০১৮ সালে ১৫৭ টিকে এবং ২০১৯ সালে ১৯০ টি সংস্থাকে রুগ্ন করে দেওয়া হয়। অথচ সরকারি সংস্থাগুলো সরকারকে দেয় কর্পোরেট কর, মেটায় লোনের সুদ, দেয় কাস্টম ডিউটি,দেয় জি এস টি, দেয় ডিভিডেন্ট এবং দেয় আরও অন্যান্য ডিউটি। এসব বাবদ প্রতিবছর সরকার পায় প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা পি এস ইউ থেকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল,কর্পোরেট সংস্থাগুলো এ সব বিষয়ে ব্যাপক ছাড় পায়। অর্থাৎ সরকার সরকারি সংস্থার স্বার্থ দেখে না,স্বার্থ দেখে বেসরকারি সংস্থার। অথচ জনগণ ভোট দেয় সরকার তৈরির জন্য। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো যা উৎপাদন করতো,এখন তা বেসরকারি কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন।
মনে রাখতে হবে,দেশটা এখনও মে চরম দেউলিয়া হয়ে যায়নি, তার অন্যতম প্রধান কারণ পাবলিক সেক্টর ইউনিটগুলির সার্বিক অবদান। আজ সেগুলোকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে দেশটাকে চূড়ান্ত দেউলিয়াপনার দিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত দালাল সংঘ-বিজেপি সরকার। এই কুকর্ম থেকে নজর ঘুরিয়ে রাখার জন্য সংঘ পরিবার করে ধর্মীয় বিদ্বেষের রাজনীতি।যদিও আরও উদ্দেশ্য আছে তাদের পরিকল্পনায়।
কর্পোরেট লুট : দেশকে যখন সাম্রাজ্যবাদী পরামর্শে(অনুন্নত দেশগুলোকে অনুন্নত না করে রাখলে এবং ধার নেওয়ার ফাঁদে না ফেললে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি খাটবে কোথায়)ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলেছে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারগুলো(দেশের শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের দালাল),তখন কর্পোরেট ভেট চলছে দেদার। ২০১৪ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত এই ৬ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ থেকে সরকার কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে ছাড় দিয়েছে ৬ লক্ষ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিদিন ছাড় দিয়েছে ৩১২ কোটি টাকা। আর প্রধানমন্ত্রী মোদী জনগণের কাছে তাঁর কর্মকাণ্ডের ঢাক পেটাতে প্রতিদিন খরচ করেছেন ৩ কোটি টাকা।
বিগত ৭ বছরে বিদেশি ব্যাঙ্ক, দেশি বেসরকারি ব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থার থেকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ঋণ নিয়েছে ১৮ লক্ষ ৩৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। মাত্র একবছর ব্যবধানে এই ছাড়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকায়।১৮ লক্ষ কোটির বাকিটাও আশা করা যায় মকুব হয়ে যাবে! অথচ এই ৭ বছরে সরকার রিজার্ভ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৫ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন ২৮৩ কোটি টাকা। আর পাবলিক সেক্টর ইউনিট (PSU) বেঁচে সংগ্রহ করেছে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এই সময়কালে ২৩ লক্ষ কোটি টাকার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে চলে গেছে বিভিন্নভাবে।এককথায় জনগণের সম্পদ দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মালিকদের হাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।সরকারের মাধ্যমে কর্পোরেট লুট চলছে,তাহলে সরকারটা কাদের?সোজা কথায় দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মালিকদের।
কর্মসংস্থানের আসল চিত্র : ক্ষমতায় আসার আগে বছরে ২ কোটি চাকরি প্রদানের প্রতিশ্রুতি ছিল মোদীর। অথচ এই ৭ বছরে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৫ জন।এর সঙ্গে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও রাজ্যগুলিতে চাকরি প্রাপ্তদের সংখ্যা যোগ করলে দাঁড়ায় ৭ বছরে মোট ৩৮ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ জন। কিন্ত এর বিপরীত চিত্র ভয়াবহ। ২০২০-২১ সালে চাকরি চলে গেছে ১কোটি ৫০ লক্ষের। ২০২১-২২ সালে চাকরি চলে গেছে ১ কোটি ১৯ লক্ষের। ২০১১-১২ সালে ভারতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৭ কোটি ৪০ লক্ষ। ২০২১-২২ সালে ১১ কোটি কমে গিয়ে কর্মরত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৪০ লক্ষে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন।দেশের কর্মসংস্থান ও দেশের অর্থনীতি কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেন পাঠকবৃন্দ?
কর্মসংস্থানের অভাবজনিত বিদ্রোহ ঠেকানোর জন্য সরকার নিয়েছে কৃষকনিধি,লক্ষ্মীভান্ডার ইত্যাদি সামাজিক প্রকল্প। এগুলিকে ভিক্ষাদান প্রকল্প ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কারণ,এটা মানুষের সম্মানজনকভাবে বাঁচার ব্যবস্থা নয়। ধুঁকে ধুঁকে মানুষ মারার ব্যবস্থা। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার প্রতি চরম অবমাননা ছাড়া আর কিছু না।মনে রাখতে হবে,যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ও সম্মানজনক পারিশ্রমিক একজন নাগরিককের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার মৌলিক অধিকার।
জমি বিক্রয় : সরকারি সংস্থা ও জমি বিক্রির জন্য মোদী সরকার ৫ টি কোম্পানি তৈরি করেছে। যথা:(১) ন্যাশনাল ল্যান্ড মানিটাইজেশন কর্পোরেশন।(২) ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট।(৩)ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড।(৪)ইনভেস্ট ইন্ডিয়া।(৫)ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন। বিইএম,এইচএমটি,রেল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রভৃতি সরকারি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ একর জমি বিক্রি করছে উপরোক্ত ৫ টি সংস্থার মাধ্যমে। সংস্থা ৫ টির উচ্চপদে মাইনে দিয়ে বসানো হয়েছে জমির দালালদের। সরকারি অভিজ্ঞ আমলারাও পরিত্যায্য। একেই বলে মধ্যস্বত্ব।রেলের ১১ লক্ষ একর জমির ১.২৫ লক্ষ একর বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে ১৮ লক্ষ একর।এর মধ্যে ১.৬ লক্ষ একরে আছে ক্যান্টনমেন্ট। এর বাইরে আছে আরও ১৬ লক্ষ একর।এই জমিটাও বেঁচারাম সরকার বেঁচে দিতে চাইছে। সরকারি ভূ-সম্পত্তি দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মালিকদের হাতে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। অথচ তারা না করছে উৎপাদন,না সৃষ্টি করছে কর্মসংস্থান।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : সাধারণত মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চাহিদার থেকে উৎপাদন কম হলে। বা কালোবাজারি করে চাহিদার থেকে বাজারে যোগান কম দিলে। অথবা উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে। বা দেশে উৎপাদন না হলে যদি আমদানি করতে হয় আর সেই আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেশি হলে। নানা কারণে পণ্যের উপর করের বোঝা চাপলে।এর সবক’টি কারণ ভারতে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী।
তবে এই মুহূর্তে ভারতে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ আমদানি নির্ভরতা ও দেশি-বিদেশি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া। আর এই দায় পরিশোধের টাকা জোগাড়ের জন্য অস্বাভাবিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি।
লাগাতার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে।এর ফলে মজুতের পরিমাণ কমছে। তৈরি হচ্ছে যোগান সংকট। ফলত দাম বৃদ্ধি।ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া। ব্যবহারিক জীবন থেকে প্রতিনিয়ত ছাঁটাই হচ্ছে নানা জিনিস। পরিণতি উৎপাদন ও পরিষেবায় ভাঁটা। কর্মসংস্থান আরও কমে যাওয়া। ফলে মুদ্রাস্ফীতি অনিবার্য।সেই কারণে রপ্তানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি। তাতে রপ্তানি কমে যাওয়া। তার তুলনায় প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বেড়ে যাওয়া।ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে চলেছে ক্রমশঃ।
বর্তমানে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ দেড় লক্ষ কোটি টাকার কাছে। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি,বাজেট ঘাটতি ও উপরে উল্লেখিত ১৫২ লক্ষ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি ঋণ ও অন্যান্য দায় মেটাতে সরকার অবিরাম জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে চলেছে।
উৎপাদন ডাউন হয়েছে পারচেজিং ম্যানুফ্যাকচারিং ইনডেক্স অনুসারে ৫৪.৯ শতাংশ। যে সব পণ্য আগে দেশে উৎপাদন করা হতো এখন তা আমদানি করা হয়।ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারতের খাদ্যশস্য ও সবজি রপ্তানি বেড়েছে।সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি। সরকার রপ্তানি বৃদ্ধির কথা বলছে, কিন্তু তুলনায় বেশি আমদানি বৃদ্ধির কথা বলছে না।যুদ্ধ থেমে গেলে ইউক্রেন ও রাশিয়া এই বাজার আবার দখল করে নেবে। তখন একধাক্কায় রপ্তানি কমে যাবে ৬০ শতাংশ।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি,যে যে কারণে শ্রীলঙ্কা আজ পথে বসেছে,সেই সেই কারণের পরিণতি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রকট হয়ে উঠেছে। আজ হোক, কাল হোক ভয়াবহ পরিস্থিতি ভারতবাসীর বৃহৎ অংশের জন্য অপেক্ষা করছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সাম্রাজ্যবাদীরা নয়া-ঔপনিবেশিক কায়দায় পুরনো উপনিবেশগুলো ধরে রাখার জন্য যে সব ফাঁদ পেতেছিল,আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, ইউএনও,এডিবি, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সহ প্রভৃতি ব্যাঙ্ক ও প্রতিষ্ঠান সেগুলির প্রধানতম। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে থেকেই ভারতসহ অন্যান্য বহু পুরনো উপনিবেশকে এই ফাঁদে আটকে ফেলা হয় উপনিবেশগুলোর দালাল শাসকশ্রেণী ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সাহায্যে। আজ সেই ফাঁদ লোহার দড়ির ফাঁস হয়ে গলায় জড়িয়ে দিয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, আফগানিস্তান সহ রাষ্ট্রসংঘ অনুমোদিত ১৯৫ টি দেশের মধ্যে প্রায় ১৮০টি দেশের।
জনগণের পিছিয়ে যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। একমাত্র জনগণের কঠিন কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী ফাঁস ছিড়ে ফেলে,দেশি প্রতিবন্ধকতা ধ্বংস করে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নেই।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!