পরিবর্তনের আঙ্গিককে বুঝেই নতুন রাজনীতির উদয় হচ্ছে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

বছর ঘুরে গেছে বেশ কয়েকদিন হল। নিজেরও লিখতে গড়িমসি, অন্যদেরও তথৈবচ। আসলে লেখাজোকা পড়ছে কে! বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ রাখাই যখন প্রায় উঠে যেতে বসেছে, তখন ‘কী পড়ি কেন পড়ি’ আরও একবার সচকিত করে বইকি। ‘একক মাত্রা’ সেই কবেই এমন বিষয়ের ওপর একটি সংখ্যা করেছিল। আসলে, পড়তেই হবে, অথবা এই এই বই, এই এই নিবন্ধ, এই এই উপন্যাস-গল্পগুচ্ছ না পড়লে জীবন রসাতলে- এমনতর বিধির বিধানের ‘জাঁতাকলে’ হয়রানি ও রসবোধ দুইই ছিল। যদি ‘গজাল মেরে’ বই পড়ানোর ইচ্ছে জাগে, তবে ধিক সে পণ্ডিতকুলকে। বই অনেক সময়ে আমাদের মাথাতেই থাকে- যেমন তিজন বাঈ’এর ‘মহাভারত’।


বাবা-কাকা বা তাঁদেরও আগের আমলে শুনেছি, ‘নভেল’ পড়া ছিল গর্হিত অপরাধ। নভেল পড়ে ছেলে-ছোকরার দল সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে, এ অভিযোগ সে কালে আকছার শোনা যেত। তাই, সে সব লুকিয়ে পড়ার ছল ও কল দুইই আবিষ্কৃত হয়েছিল। কালে কালে সে সব গেছে। শনৈ শনৈ শরৎচন্দ্র পড়ে ফেলাও সহজাত হল। ‘দেবদাস’এর আকর্ষণ সারা দেশ জুড়েই প্রবল প্রভাব ফেলল। অবশ্য এই সেদিনও ‘বিবর’ অথবা ‘রাত ভোর বৃষ্টি’ নিয়ে কম আদিখেত্যা হয়নি। আইন-আদালত, জেল-জরিমানা সব ঘুচিয়ে তবুও বাঙালি সনাতনী মধ্যবিত্ত বোম্বের ছায়াছবিগুলিকে তখনও ‘লাড়ে-লাপ্পা’ বলে গাল পাড়তে ছাড়েনি। সত্যজিতের ছবি করে খ্যাতিমান শর্মিলা ঠাকুর যখন বিকিনি পরে ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ করলেন, তখন ‘ভদ্দর শিক্ষিত বাঙালি’ তাঁকে ছিঃছিক্কার করতে রেওয়াত করেনি। সেই বাঙালিকুলের অংশবিশেষ আজও বহমান। কেন জানি মনে হয়, এই মহা ধুরন্ধর ‘শিক্ষিত’, ‘বইপোকা’ বাঙালির অংশবিশেষ কালিঘাট কন্যার মুখে ‘পবলেম’ শুনে যারপরনাই এতটাই ‘বিপন্ন’ বোধ করেন যে, ‘রাজাবাজারের ‘ওরা’ হেলমেট ছাড়া বাইক চালায়, তবু পুলিশ কিছু বলে না’ এই অজুহাতে এই ‘বাড়াবাড়ি’র দাওয়াই হিসেবে ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনিতে আশ্বস্ত হন। এঁরাই আবার হোস্টেল জীবনে ‘র‍্যাগিং’ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রোলিং’ দুইয়েই বেশ পারদর্শী। তাঁদের হা-হুতাশ ও দীর্ঘশ্বাসের অন্ত নেই।


আশার কথা, দীর্ঘকাল ছড়ি ঘোরানো স্বঘোষিত ‘বামপন্থী’ মিশেলে এই তথাকথিত সজ্জন অথচ আদ্যোপান্ত ‘মিচকেল’ ভদ্দরলোক বাঙালির আধিপত্যের যুগের অবসান হয়েছে। কথাটা বলছি এই কারণেই যে, এঁদের দীর্ঘশ্বাস ও আক্ষেপ এখন কান পাতলেই প্রকট। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এমন সব কল বেরিয়েছে যে ‘জয় জগন্নাথ’ বলে ভেসে পড়লেই হল। অভিভাবকগিরির দিন শেষ! রোদে পুড়ে পিঠ ঝামা হয়ে যাচ্ছে, তবু রাজামশাইয়ের অঙ্ক কিচ্ছুটি মিলছে না। তাই, চোখের ওপর ঠুলি দাও, আর মেহের আলির মতো চিল্লাও ‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’।


গত শতকের বিশের দশকে কলকাতা পৌরসভায় মহিলাদের ভোটাধিকার থাকা উচিত কিনা- এই বিতর্কে মহিলাদের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সরব হয়েছিলেন শিক্ষিত পুরুষ ভদ্দরজনেদের এক বড় অংশ। আজ একশো বছর পরেও দেখা যায়, খাতায়-কলমে এনারা নিজেদের যতটা বিদ্রোহী ও বেপরোয়া দেখানোর বাসনা রাখেন, কার্যত রুক্ষ বাস্তবে একেবারেই রক্ষণশীল। নয়তো, সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে শেফালি অভিনীত নার্সের চরিত্রায়ন নিয়ে অত জলঘোলার আর অন্য কোনও কারণ ছিল কী! সকলেই তো জানি, গল্পে এক শ্রমিককে মাতাল দেখালে যেমন সমস্ত শ্রমিকদের মাতাল বোঝায় না, অথবা এক অর্থলোভী চিকিৎসক কখনই গোটা চিকিৎসক সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, সেভাবেই খানিক ‘বাঁকা পথে হাঁটা’ এক ব্যক্তি যিনি নার্সিং পেশায় যুক্ত, মোটেই গোটা নার্স সম্প্রদায়কে প্রতিফলিত করে না। সাধে কি আর স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরের দিন খোদ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ খবর করে যে, বেলুড় মঠের এক ‘মাংসখেকো’ সাধুর জীবনাবসান হয়েছে! রবি ঠাকুরকেও এঁরা ছেড়ে কথা বলেননি। অথচ, কবির নোবেলপ্রাপ্তির পর এঁরা দল বেঁধে একটা গোটা ট্রেন ভাড়া করে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন রওনা দিয়েছিলেন তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে। ভাগ্যিস, কবি সে সম্মাননার ‘পানপাত্র’ নিজ ‘ওষ্ঠ স্পর্শ করা’ অবধি সম্মতি দিয়েছিলেন, ‘গলাধঃকরণ’এ নয়। খোলসা করে বললে, পত্রপাঠ বিদায়!


এখন প্রশ্ন হল, এই সমস্ত বিড়ম্বনার কতটা কী গায়ে লাগে! রামকৃষ্ণদেব দেব বলতেন, সংসারে থাকবি পাকাল মাছের মতো। অর্থাৎ, চরে বেড়াবি, কাদার মধ্য দিয়েও যাবি, কিন্তু গায়ে মাখবি না। কেউ পারেন, কেউ পারেন না! সম্ভবত না পেরে, বিদ্যাসাগর কলকাতা ছেড়ে কারমাটাড়ে আশ্রয় নিলেন। ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং’এর গোড়ায় সত্যজিতের দল যখন বোড়ালের গ্রামে ঢুকতেন তখন স্থানীয় এক ব্যক্তি (সুবোধদা- যার সঙ্গে সত্যজিতের পরে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল) হৈ হৈ করে চিল্লিয়ে উঠতেন, ‘ফিল্মের দল এয়েচে, লাঠি-বল্লম নিয়ে সব এসো’। শেষমেশ অবশ্য সত্যজিৎ পেরেছিলেন।এখন চারপাশে সব শব্দকল্পদ্রুম! সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি শব্দের ভেলা। অথবা ছবির পর ছবির আকাশ-পাতাল। চীৎকার-চেঁচামেচি-গান-হুল্লোড়। কে কাকে কোনটা বেছে নিতে বলবে! কেই বা কার কথা শুনছে! হাতে কলম-পেনসিল পেলে শিশু যেমন যেখানে যা খুশি দাগ কাটে, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালগুলি এখন তেমন যেমন খুশি আঁক-কাটার, আবার হাগু-হিসু দিয়ে ভরিয়ে দেবার। বঙ্কিম লিখেছিলেন, উহারা একটি পত্রিকা বার করিয়াছে, উহাদের কিছু রস দাও; এখন আরও খোলামেলা- উনাকে একটু খুশি খুশি দেখছি, উনার মুখে হেগে আসি। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ এমনই হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার বিষয়, কিন্তু ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়’ যে বহু পুরনো প্রবাদ! অতএব, এই ডামাডোলের বাজারে যা ঘটছে- সকলেরই মত ও মতামত প্রকাশের সুযোগ অবারিত এবং সেই সুবাদে সত্য-মিথ্যাকে কতিপয়ের পকেটস্থ রাখার আর কোনও উপায় নেই। আজ যা সত্য, আজ যা বিশ্বাসযোগ্য, আজ যা জনপ্রিয়, কাল তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। ‘কাহারও সমান নাহি যায়’- সত্যি সত্যি, ‘ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল’।


তাহলে আমরা কি এক সুনিপুণ নৈরাজ্যবাদের কোটরে প্রবেশ করেছি? গান্ধী নিজেকে একজন নৈরাজ্যবাদী হিসেবে ভাবতে চাইতেন। গান্ধীর কাছে নৈরাজ্যবাদের অর্থ ছিল শাসকহীন এক আত্মশাসন। যে কারণে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি কংগ্রেস দলটাকে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভদ্দরজনেরা এই ধরনের নৈরাজ্যবাদ পছন্দ করেন না। কারণ, তাহলে তাদের হাতে আর ক্ষমতার রাশ থাকে না। আর তা না হলে তারা যে নিতান্তই অসহায় ও সেই হেতু অতীব হিংস্র হয়ে ওঠেন তা সুবিদিত; আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দরুণ তা তীব্র ভাবে প্রকটমান। সেই অসহায়তা মিশ্রিত হিংস্রতা এবং তজ্জনিত আক্ষেপ ও অভাববোধ থেকেই উদিত হয়েছে ‘চক্রান্তের তত্ত্ব’। যখন ঘটনা মোটে মনের মতো এগোচ্ছে না, তখন নিশ্চিত এক চক্রান্ত চলেছে কোথাও। কিছু শক্তিধর মানুষ গোপনে কোথাও মিলিত হয়ে বসে তৈরি করেছে ভবিষ্যতের মাস্টারপ্ল্যান। তা কোভিডের নানান ভ্যারিয়েন্ট হোক কি ডিজিটাল দুনিয়ার অবিশ্বাস্য বাঁক- সবটাই পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাইই যদি হয়, তাহলে নতুন করে বোঝার আর কোনও দরকার পড়ে না। ‘সবই ব্যাদে আছে’র মতো সরল সমাধান।


এই সব মিলিয়ে এখন অতএব এক হুলুস্থুল কাণ্ড। মনে পড়বে, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের একদল শ্রমিক (লুডাইট) মনে করেছিলেন, নব-উত্থিত পুঁজিবাদের গর্ভে জন্মজাত আধুনিক যন্ত্রপাতিই হল যত দুঃখকষ্ট ও বৈষম্যের হেতু, অতএব, সেগুলিকে ভাঙো ও ধ্বংস করো। কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে তো মাটিতে ভাত খাওয়া যায় না- যন্ত্র তো নিথর, নির্বাক কিছু উপাদান মাত্র, যাকে কাজ লাগিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে মুনাফার হারকে উর্ধ্বমুখি করে মালিক শ্রেণি। যে যন্ত্র আখেরে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে তা তো মানুষের কল্যাণেই লাগে। আসলে, যন্ত্র নয়, যন্ত্রকে কব্জা করে শোষণের হারকে বাড়ানোর মধ্যেই ছিল সংঘাতের মূল অবস্থান। তা যখন শ্রমিকেরা বুঝলেন তখন আর যন্ত্র ভাঙার কারণ থাকে না, কারণ আন্দোলনের বর্শামুখ পেয়ে গেছে রাজনৈতিক-অর্থনীতির মূল অভিমুখ শ্রেণি শোষণকে। আজও যারা ডিজিটাল দুনিয়ার অবাক কাণ্ড দেখে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অসীম কর্মযোগ দেখে বিহ্বল হয়ে উপায় হাতড়াচ্ছেন- তাঁদের বুঝতে হবে, যা গেছে তা গেছে। যন্ত্রের ওপর গোঁসা করে পাড়ার দোকান থেকে চাট্টি মালপত্তর কিনে ফেসবুকে তার ছবি সাঁটিয়ে বড়জোর খানিক কলার তুলে সামান্য বাহবা আদায় হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিমুখকে তাতে একটুও নাড়ানো যায় না। কারণ, আপনারও কথা জানানোর জায়গা সেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইউটিউব।


পুঁজিবাদের উত্থানের মধ্যে মার্কস সাহেব যেমন এক নতুন শ্রেণির উদয়কে দেখেছিলেন- সে সময়ের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের অ্যাসেমব্লি লাইনে কর্মরত হাজার হাজার মজুর শ্রেণি, যাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছুই ছিল না- আজও তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নতুন পুঁজিবাদের গর্ভে যে নবতর শ্রেণি বিন্যাস নিত্য নির্মিত হয়ে চলেছে, তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আগামী ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বীজ। সে সম্ভাবনা কীভাবে ও কোন পথে আবারও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও পরিবর্তনের স্বর্ণযুগ হয়ে উঠতে পারে তার জন্য হয়তো আরও একটি নতুন ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু কথায় বলে, পথেই হবে এ পথ চেনা- সেও কম বিস্ময়ের নয়। ভদ্দরলোকের প্রাঙ্গণ ছেড়ে শ্রমজীবী মানুষ নিজের পথ ঠিকই বেছে নেবেন। এ প্রসঙ্গে ‘ম্যানিফেস্টো অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি’র একটি ভূমিকায় এঙ্গেলস স্পষ্ট করেছিলেন, কেন তিনি ও মার্কস ‘সোশ্যালিস্ট’এর বদলে ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটিকে চয়ন করেছিলেন। আসলে, ‘সোশ্যালিস্ট’ শব্দটি সে সময়ে চিহ্নিত করত সমাজের সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ও ভদ্রজনেদের যারা শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন নিয়ে কচকচি করে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। আর কমিউনিস্ট ছিলেন তাঁরা যারা বাস্তব হাতড়ে হাতড়ে সত্যিকারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোতে চাইতেন।


ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে না। আজকের বার্তা লেখা হবে আগুয়ান প্রযুক্তির উত্তপ্ত গর্ভেই। এর চলমানতা ও পরিবর্তনের আঙ্গিককে বুঝেই নতুন রাজনীতির উদয় হচ্ছে ও হবে!

* সৌজন্যে একক মাত্রা ব্লগ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!