সুচিত্রামাসি আর আমি


সোনালী গুপ্ত বসু

সাদা শার্ট, টাইট জিন্স, কলার পিছনের দিকে এলিয়ে রাখা। চোখে গো-গো সানগ্লাস। নো-মেকআপ সুচিত্রা মাসির এই রূপ আমার চোখে আজও লেগে। ‘দেবী চৌধুরাণী’র শুটিং-এ এ ভাবেই আসতেন উনি। ঋজু ব্যক্তিত্বই ছিল ওঁর সবচেয়ে বড় প্রসাধন।
বজরায় উঠে মাত্র এক ঘণ্টার মেকআপে উনি হয়ে উঠতেন দেবী চৌধুরাণী!
প্রত্যেক দিন এসেই বাবাকে (দীনেন গুপ্ত, ‘দেবী চৌধুরাণী’র পরিচালক) একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট দিতেন। বাবা যদিও গোল্ড ফ্লেক খেতেন, কিন্তু সুচিত্রামাসি ফাইভ ফিফটি ফাইভই দিতেন। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, “এটা কি ঘুষ?” উনি হাসতেন। কোনও দিন নিজেই এসে বলতেন, “এই নিন ঘুষ।”

আমার বাবা-মার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা খুব সহজ ছিল। কী রকম জানেন? হয়তো ফোন করে মা-কে বললেন, “কাজল রেডি হও, তোমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে একটু বেরবো।” মা কোনও রকমে শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলেন। উনি গাড়ি নিয়ে আমাদের লেক গার্ডেন্সের বাড়ি এসে মাকে তুলে নিউমার্কেটে গিয়ে শাড়িটাড়ি কিনলেন। মা চিরকালই একটু চুপচাপ প্রকৃতির। সহজে কিছু কিনতে চাইতেন না। আর উনি বলতেন, “কাজল তোমার মাথা নাড়া দেখে আমি বুঝতে পারি না, পছন্দ হল, না হল না!”
ঘরোয়া আসরে খুব সহজ, স্বাভাবিক… বাচ্চাদের মতো হাসতেন সুচিত্রামাসি। একেবারে খিলখিল করে। মনে আছে, ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ‘দেবী চৌধুরাণী’র শুটিং চলছে। অন্য একটা সেটে ছায়াদেবী কী একটা ছবির শুটিং করছিলেন। মাঝের জায়গাটায় বেঞ্চ পেতে সবাই মিলে আড্ডা হতো। ও দিক থেকে ছায়ামাসি আসতেন। এ দিক থেকে বাবা-মা, সুচিত্রামাসি আর তার লেজুড় হয়ে আমি। সবাই বসে থাকলেও সুচিত্রামাসি দাঁড়িয়ে থাকতেন। ছায়ামাসিকে অক্লেশে বলতেন, “তুমি আমাকে ওই সিনটায় মেরে দিও না। প্লিজ, প্লিজ।”
আসলে সত্যিকার পাওয়ারফুল অভিনেতারা যে কোনও সময়ে পাশের জনকে হারিয়ে দিতে পারে। সেটা সুচিত্রামাসির মধ্যেও কাজ করত, ভাবলে অবাক লাগে।

বাবা-মায়ের সঙ্গে সুচিত্রামাসির অনেক দিনের পরিচয়। তবে আমার সঙ্গে পরিচয় হল ‘দেবী চৌধুরাণী’র সময়েই। তখন আমার বয়স কত? বড় জোর ষোলো। তার পর থেকে সুচিত্রামাসিকে যত দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি। মনে হয়েছে, ওপর ওপর একটা কাঠিন্য নিয়ে চললেও ভেতর থেকে খুব স্নেহশীল ছিলেন উনি। যে কারণে আমার বিয়ের পরদিন কন্যা বিদায়ের পর যখন মা-বাবা খুব মুষড়ে রয়েছেন, তখন প্রথম ফোনটা করেন সুচিত্রামাসিই। মা-বাবাকে বলেন, “জানি, একমাত্র মেয়ে… মনখারাপ। কিন্তু মেয়েকে তো বিদায় করতেই হবে।”
তত দিনে আসলে মুনমুনদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্নেহশীল মায়ের মন ঠিক আর এক মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরেছিল।
আর একটা কথা মনে পড়ছে। আমার বিয়ের ঠিক আগের রাতে কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ আমাদের বাড়ি চলে আসেন সুচিত্রামাসি। রাত প্রায় একটা অবধি থেকে আমার তত্ত্ব-শাড়ি, আমি কী পরব, সব দেখে গল্পগুজব করে তার পর ফিরলেন। আমাকে রুপোর একটা টি-সেট দিয়েছিলেন।
আমার বিয়ে হয় বাগবাজারের নন্দলাল বসুর বাড়িতে। সেটা উনি শুনেছিলেন। জানতেন, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকান্দ এই বাড়িতে এসেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্রপাতও এ বাড়িতে। এমনকী ‘কথামৃত’তেও এ বাড়ির উল্লেখ আছে। উনি এক বার এ বাড়িতে আসতে চেয়ে বাবার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তা আর হয়ে ওঠেনি। সেই আফশোস আমার থেকেই গেল।

দীনেন গুপ্ত ও সোনালী গুপ্ত বসু-র সৌজন্যে প্রাপ্ত।
অনুলিখন: নিবেদিতা দে। কৃতজ্ঞতা : জলসা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!