মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা: মোদি উচ্চারণ না করলেও স্মরণ করছে বাংলাদেশ
মিলন দত্ত
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ইন্দিরার নাম না নেওয়ায় রাহুলের ক্ষোভ’ — এটা এদেশের কোনও খবরের কাগজে সংবাদ শিরোনাম নয়। বাংলাদেশের দৈনিক ‘প্রথম আলো’ এই খবরটা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দিল্লিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম উচ্চারণ না করায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রচারক দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর কাছে এর থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় কি? কেবল প্রথম আলো নয়, বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্র ওই ঘটনার পরের দিন প্রথম পাতায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে খবরটা করেছে। কারণ বাংলাদেশ জানে এবং মানে বাংলা নামে ওই দেশের জন্মযন্ত্রণা, আবেগ, ভালবাসার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কটা কি। অবশ্য বিজেপি নেতাদের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কোনও আবেগ থাকার কথাও নয়। একাত্তরের ওই কালপর্বে বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের কি অবস্থান ছিল তা দেশের মানুষ কমবেশি জানে। আমরা বরং এখন দেখি মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো কি লিখছে।
১৬ ডিসেম্বর ‘প্রথম আলো’য় ছাপা হয়েছে ‘ইন্দিরা গান্ধীর একাত্তরের বক্তৃতামালা’। ওই নিবেদনের ভূমিকা হিসেবে লেখা হয় , ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত একটি প্রধান মিত্র শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। দেশটির সাধারণ মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতার পাশাপাশি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পালন করেছিলেন অসামান্য ভূমিকা। পাঠকদের জন্য এখানে রইল একাত্তর জুড়ে তাঁর নানা বক্তব্যের একটি নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।’ চারটি বক্তৃতা পর পর ছাপা হয়েছে— ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ লোকসভায় বিতর্কে অংশ নিয়ে যে বক্তৃতা করেছিলেন তার পূর্ণাঙ্গ বয়ান, ২৮ সেপ্টেম্বর ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে বক্তব্য’, ১৫ নভেম্বর ‘একাধিক দেশ সফর শেষে লোকসভায় দেওয়া ভাষণ’, ৩ ডিসেম্বর ‘মধ্যরাতের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ’ এবং ৬ ডিসেম্বর লোকসভায় বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে বক্তৃতা। ওই ভাষণে ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে লোকসভাকে জানাতে চাই যে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে এবং বাংলাদেশ সরকারের কয়েকবারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এবং ভারত সরকার সর্বোত্তম সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমাদের আশা, সময়ের ব্যবধানে আরও অনেক রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং খুব শিগগির তারা জাতিসংঘের সদস্য হবে।’ ওই লেখার সঙ্গে ছবিটা ছিল, ১৯৭১-এ শরনার্থী শিবিরে ইন্দিরা গান্ধী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ইন্দিরা গান্ধীকে স্মরণ করার এর চেয়ে উত্তম উপায় সম্ভবত আর হয় না।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকায় গত ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, বিমল সরকারের লেথা ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধী’। বিমল সরকার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বা রাষ্ট্রনায়কদের নামের তালিকায় যার নামটি কৃতজ্ঞচিত্তে বেশি স্মরণ করা হয়, তিনি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী। নামটির সঙ্গে ধৈর্য, শক্তি ও সাহস এবং দূরদর্শী-প্রত্যুৎপন্নমতি এমনকিছু শব্দ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে। এমন দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী রাজনীতিকের উদাহরণ খুবই বিরল। স্বাধীন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী নামগুলো অবিচ্ছেদ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে তিনি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।’ ওই নিবন্ধে আরও আছে, ‘ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অনেক বড় মাপের একজন মানুষ। বড় মাপের রাজনীতিক। প্রকৃত অর্থেই স্টেটসম্যান। নিজের দেশে এবং বহির্বিশ্বে তার কর্মপরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। তার সহৃদয়তা এবং আগ্রাসী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। বিজয়ের মাসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এ মহীয়সী নারীকে স্মরণ করি।’
‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার ৩১ অক্টোবর সংখায় একই বিষয়ে নিখেছেন মানিক লাল ঘোষ। লেখার শিরোনাম ‘ইন্দিরা গান্ধী: চরম দুঃসময়ে বাঙালির পরম বন্ধু’। মানিকবাবু লিখছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে অনেক দেশই এটাকে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছে। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্ব মিডিয়ায় দেয়া বক্তব্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ায় এর ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের করা যুদ্ধকে বাকি সব দেশ গৃহযুদ্ধ হিসেবেই দেখতে চেয়েছে। শুরু থেকেই কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও রাষ্ট্রপ্রধানরাও সেভাবেই বিশ্লেষণ করছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ততদিনে পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ব বাংলা বলে সম্বোধন করছিলেন।’
বাংলাদেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন রিপোর্টার সুখরঞ্জন দাশগুপ্তর একটা লেখা ছাপা হয় গত ২৯ নভেম্বর। লেখাটির নাম ‘ইন্দিরা গান্ধীর শেষ এবং অসমাপ্ত সাক্ষাৎকার’। সেখানে তিনি লেখেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলার লোক আমাকে ফোন করে জানতে চান—ইন্দিরা গান্ধী কে ছিলেন? তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কী করেছেন? আমি দু-এক জনকে জবাব দিয়ে বলেছি, আপনারা আপনাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসটা একবার পড়ুন অথবা আপনাদের পূর্বসূরিদের জিগ্যেস করুন, ইন্দিরা গান্ধী কে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকাটাই-বা কী ছিল। আমি তাদের বলেছি, ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিদি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষকে ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং ভারতের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে। সেজন্য সে সময়কার মানুষজন, যারা এখনো জীবিত আছেন, তারা জানেন—ইন্দিরা গান্ধী কে।’
গত ১৪ ডিসেম্বর ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় শাহাব উদ্দিন মাহমুদ লেখেন ‘মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী’। তিনি সেই সময়কার নানা ঘটনা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন। তিনি ওই নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল অসাধারণ। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সাল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন হয়, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। এর আগে ২৭ মার্চ ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় এক প্রস্তাবে অবিলম্বে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। এরপর ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানায়। ইন্দিরা গান্ধী তখন বিচক্ষণতার সঙ্গে ধীরে চলো নীতি ও কূটনৈতিক কৌশলের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ দেন। পরে ১৭ মে ইন্দিরা গান্ধী যান পশ্চিমবঙ্গে। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, শরণার্থী বিষয়ে কেন্দ্র তাদের পাশে আছে ও থাকবে। ভারতীয় কমান্ডারদের প্রতি ইন্দিরার আদেশ ছিল, ‘আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানী কামানগুলো নিস্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের অভিযান চলবে।’
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এপ্রিলের ৪ তারিখ পর্যন্ত ১০টা দিন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বাধীনতা ঘোষণার পর একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে, অন্যদিকে তাঁর প্রথম সারির সহযোদ্ধারা নেতার নির্দেশেই আত্মগোপন করে গোপন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছন। এই ১০ দিন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীসহ সরকারের নেতৃস্থানীয়দের অবস্থান কী হবে? সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করবে কিনা? করলেও তা কীভাবে, কার মাধ্যমে? বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ হবে কীভাবে?
এই সময়টা নিয়ে ‘সমকাল’ পত্রিকায় গত ৪ এপ্রিল প্রকাশিত একটি অনবদ্য নিবন্ধ— ‘ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজুদ্দিনের সেই বৈঠক’। সেখানে লেখক শেখ রোকন বলছেন, ‘অনেক আশা-নিরাশা পেরিয়ে এপ্রিলের ৩ তারিখ রাতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয় তাজউদ্দীন আহমদের। ওই বৈঠকই মোড় ঘুরিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে করে তোলে অবশ্যম্ভবী। কোনো কোনো লেখক ও গবেষক মনে করেন, ওই বৈঠক ছিল অনানুষ্ঠানিক। দুই নেতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় পর দিন ৪ এপ্রিল।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং তার অর্জন নিয়ে বাঙালি যতদিন কথা বলতে, ওই মহান কালপর্বকে যতদিন স্মরণ করবে ততদিন ওই ভূখণ্ডের মানষ মনে রাখবে বাংলা নামে দেশটির জন্মগ্রহণে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা।
( সপ্তাহ পত্রিকায় প্রকাশিতব্য )