ক্রিকেটের মাঠে জাত্যাভিমান : এ কী অসুখ? লিখলেন অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলায় পাক জয়ে উল্লাস করে দেশদ্রোহী আইনে গ্রেপ্তার হলেন একজন, বাজি পোড়ালেন যাঁরা তাঁদের জন্য বর্ষিত হল ধিক্কার, এটা কি শুধুই খেলা ?

প্রথম সিরিজ থেকেই টানটান উত্তেজনা। সাল ১৯৫২। তখন T-20 বা সীমিত ওভারের খেলা শুরু হয়নি, ছিল কেবল ৪ বা ৫ দিনের টেস্টম্যাচ। কখনও ৬ দিনের টেস্টম্যাচও হয়েছে। ভারত-পাক প্রথম সিরিজের প্রতিটি টেস্টম্যাচ হয় ৪দিনের। বিরুদ্ধ দেশটার নাম পাকিস্তান সংশয় ছিল তারা দল গড়তে পারবে তো! সংশয় মিটিয়ে তারা এসেছে ICC-র পূর্ণ সদস্য হয়ে।
এমন উত্তেজনা হকি সিরিজ নিয়েও। 56-তে
অলিম্পিক আসরে তারা ভারতের মুখোমুখি হয়েছে ফাইনালে। হেরেছে। পরের অলিম্পিকেই পাকিস্তান জিতেছে। যদিও আমরা ভারতবাসীরা ধরেই নিয়েছি যে ওদের যে কোনও খেলায় গো-হারা হারাব।
তেমনটি হয়নি। হকিতেও না, ক্রিকেটেও না।

52 -তে যে দল নিয়ে তারা খেলতে আসে তার সদস্যরা যে একেবারে অচেনা ছিল এমন নয়। ইলাহি তো তার আগে ভারতের হয়েও খেলেছে, যেমন ওদের অধিনায়ক কারদার। সেবার ফজল মামুদের গতিতে মাথা নোয়াতে হয় ভারতীয় ব্যাটারদের। ওরাও কাবু হয় আমাদের গোলাম আহমেদ ও ভিন্নু মাঁকড়ের ঘূর্ণিবলের জাদুতে। সিরিজ আমরা জিতি কোনক্রমে। তবু ভারতীয় দর্শকদের হাঙ্গামা দেখতে হয় বিশ্বকে, লক্ষ্ণৌ মাঠে পাকিস্তান তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জেতায়।
এরপর কোনও সিরিজ ওরা জিতেছে, কোনও সিরিজ আমরা,( প্রথম সিরিজটা আমরা ২-১ জিতলেও, এযাবত পাকিস্তানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মোট ৫৯ টি টেস্টে ভারত জয়ী হয় মাত্র ৯ টিতে পাকিস্তান জয় পেয়েছে ১১টিতে।)। ভারত-পাক উপমহাদেশের ক্রিকেট থেকে দিনে দিনে বিশ্ব পায় পঙ্কজ রায়,পলি উম্রিগড়,কপিলদেব, বীরেন্দ্র সেহয়াগের মতো ক্রিকেটার, পায় হানিফ মহম্মদ, ফজল মাহমুদ, ইমরান খান, আসিফ ইকবালের মতো ক্রিকেটার।

৬৫-র যুদ্ধ আর ৭১-র যুদ্ধ দুদেশের তিক্ততা বাড়ালে তার ছায়া পড়ে খেলার জগতেও। ক্রিকেট ব্যতিক্রম নয়। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি সবেতেই। কিন্তু কেমন হয়? এর জন্য দায়ী কে? কেউ বলে দর্শকদের মানসিকতা, কেউ দোষ দেয় সংবাদমাধ্যমকে। টেস্ট ছেড়ে যত ক্ষুদ্রতর সংস্করণের দিকে এগিয়েছে ক্রিকেট খেলা ততই যেন ভারতের সাফল্য বেড়েছে।
সংবাদমাধ্যম তো চলতি বিশ্বকাপে ভারতকে জেতার আগেই যেন জিতিয়ে দিতে ব্যস্ত ছিল, তবে আমাদের অনেকেরও ধারণায় তেমন জয় কাংখিত ছিল। তাই চলতি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের জয়ে আমাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ভূমিকা নিয়েছে। পাকিস্তানের কাছে এই পরাজয় আমাদের প্রকৃত মূল্যায়নে নিশ্চয় সাহায্য করবে।

এমন মানুষও দেখেছি যারা ভাবেন যদি দেশটা ভাগ না হতো! তাঁরা স্বপ্ন দেখেন,
ভারতের হয়ে বল করতে চলেছেন ওয়াসিম আক্রাম, ইমরান খান, কপিল দেব, মাঁকড়, প্রসন্নরা; আর ব্যাট হাতে আসছেন হানিফ মহম্মদ, সুনীল গাভাসকার, মিয়াঁদাদ, শচীন তেন্ডুলকার. আজাহারউদ্দিন……
স্বপ্ন স্বপ্নই। কেউ কেউ এমন স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের দল নিয়েও। দেখুন। কিন্তু যারা ক্রিকেট -যুদ্ধ দেখতে চান তাঁরা কেন ভীতি-সঞ্চারক হুংকার আর জাত্যাভিমান নিয়ে খেলার আসরকে কলূষিত করতে আসবেন? এই রোগ বা অসুখ তো বিশ্বব্যাপী, কোথাও জাত্যাভিমান, কোথাও বর্ণবৈষম্য, কোথাও রাজনীতি, মাঠের বাইরের উত্তেজনা টেনে আনা হচ্ছে খেলার মাঠে। হায়! এখন আর কোনও অচিন্ত্যকুমার বা শঙ্করীপ্রসাদ এই খেলার রাজনীতিতে থাকতে চান না। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!